অাকাশ নিউজ ডেস্ক:
প্রকৃত মুক্তি হলো নিজের প্রবৃত্তির ওপর কন্ট্রোল থাকা। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো আপনাকে কোনো খায়েশ ও চাহিদা দাসে পরিণত করতে না পারা। এই অর্থে ধর্মপ্রাণ মোমিনরাই পূর্ণ স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতা এ জাতীয় কোনো নিয়ম-কানুনে বিধিবদ্ধ নয়। দ্বীন ও ধর্ম তাদের সব ধরনের প্রবৃত্তি, খায়েশ ও লোভ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করে দিয়েছে।
স্বাধীনতা শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়, যেমনটা অনেক লোক মনে করেন যে, নেতৃত্ব ও স্বাতন্ত্র্যে জাতির নিজ প্রাপ্য অর্জন করে নেয়া। এটি তো রাজনৈতিক স্বাধীনতা। এর পেছনে আছে চিন্তা ও চেতনা, মন ও মননশীলতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং মানবিক মূল্যবোধে জাতির স্বাধীনতা। সেভাবে স্বাধীনতা তা-ই নয়, যেমনটা অসংখ্য তরুণের ধারণা, মানুষ নিজ চাহিদা ও খায়েশগুলোর পেছনে চলতে থাকবে যা ইচ্ছে খাবে, যা ইচ্ছে করবে, নিজের প্রতিটা চাওয়া-পাওয়া বাস্তবায়ন করবে। এটা প্রথমত বিশৃঙ্খলা এবং পরিণামে নিকৃষ্টতম দাসত্ব।
বিশৃঙ্খলা এজন্য যে, পৃথিবীতে এমন কোনো অবাধ স্বাধীনতা নেই, যেখানে কোনো ধরনের বাধা-নিষেধ এবং আইন-কানুন নেই। পৃথিবীতে সব জিনিসেরই নির্ধারিত নীতি ও বিধি রয়েছে। ব্যক্তির স্বাধীনতা ততক্ষণ নিরাপদ হবে না, যতক্ষণ অন্যদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার স্বার্থে। এতেই দুনিয়ার তাবত নিয়ম-নীতি, বিধি-নিষেধ এবং সংবিধান প্রণয়নের মূল রহস্য নিহিত। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, বড় বড় শহরে গাড়ি ড্রাইভিংয়ের নিয়ম। আপনি কি তাদের রেখাপথ থেকে বের হয়ে নিজের ইচ্ছামতো গাড়ি চালাতে পারবেন? সাধারণ বিনোদনের কথাই ধরুন, আবাসিক এলাকার সড়কপথে আপনি কি পারবেন গভীর রাতে গান বাজাতে? স্বাধিকার চর্চার কথাই ধরুন, আপনি কি পারবেন আপনার এমন কোনো মত ও মন্তব্য সমাজে ছড়িয়ে দিতে, যা রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? আপনার জাতি যখন যুদ্ধের একেবারে যৌবনকালে, তখন শত্রুপক্ষের সঙ্গে আপনি কি নিজ থেকে সন্ধির আহ্বান করতে পারবেন? আপনি কি পারবেন শত্রুপক্ষের সঙ্গে অস্ত্রের ব্যবসা করতে কিংবা নিজ দেশের উৎপন্ন দ্রব্য প্রতিপক্ষ দেশে পাঠাতে, কোনো ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হওয়া ছাড়া? বরং আপনি ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলতে পারেন!
কখনও স্বাধীনতায় পূর্ণতা আসে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। রোগীকে যখন ক্ষতিকর খাবার থেকে বারণ করা হয়, সাময়িকভাবে তার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, যাতে পরবর্তীতে পছন্দের খাবার গ্রহণের স্বাধীনতা নিরাপদ থাকে। অপরাধীকে জেলে বন্দি করে রাখা হয়, কিছুদিনের জন্য তার স্বাধীনতা হরণ করা হয়, যাতে সে পরবর্তীতে নিজের স্বাধীনতা উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে শেখে, নিজেরও ক্ষতি করবে না এবং লোকদেরও ক্ষতি করবে না।
অন্যদিকে মানুষ একা একাই বাস করে না। একটা সমষ্টিগত সমাজের অংশ হিসেবে বাস করে। প্রিয় নবীজি (সা.) এ ক্ষেত্রে চমৎকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন ‘যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে আর যারা সেগুলোকে নিজেদের প্রবৃত্তির খেয়ালে লঙ্ঘন করে, উভয়ে যেন তাদের মতো, যারা একই জাহাজে আরোহণ করে। তাদের একাংশ জাহাজের উপরের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে এবং অন্যরা এর নিচের তলায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। যখন নিচের লোকদের পিপাসা মেটানোর প্রয়োজন হয়, তখন তাদের জাহাজের উপরের অংশের লোকদের অতিক্রম করে যেতে হয়। তাই নিচতলার লোকরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে আমরা যদি জাহাজের নিচের দিকে একটা ফুটো করে নিই তাহলে জাহাজের উপরের তলার লোকদের কোনো সমস্যা করব না। এখন যদি উপরের তলার লোকরা নিচতলার লোকদের এ কাজ করতে দেয়, তবে নিশ্চিতভাবেই তারা সবাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। আর তারা যদি তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখে, তবে তারা (উপরতলা) রক্ষা পাবে এবং এভাবে (জাহাজের) সবাই রক্ষা পাবে। ( বোখারি : ২৩৬১)।
এটা হলো মানবতার বিপ্লবী শিক্ষকের দেয়া উৎকৃষ্ট নমুনা। এখানে প্রকৃষ্ট ব্যবধান তুলে ধরা হয়েছে ব্যক্তির এমন স্বাধীনতা, যা কারও জন্য ক্ষতিকারক নয় এবং এমন স্বাধীনতার মাঝে, যা সমাজের ক্ষতিসাধন করে ও সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে, যদি ওই ব্যক্তিগত ইচ্ছা ঘোড়ার লাগামমুক্ত ছেড়ে দেয়া হয়।
এটা দাসত্ব ও পরাধীনতা এজন্য যে, আসল স্বাধীনতা হলো মানবিকতায় আপনার সমমানের অথবা নিম্নমানের কারও কর্তৃক আপনাকে দাসে পরিণত না করা। আর এ বিশৃঙ্খলা, যাকে কিছু লোক ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে ব্যক্ত করে, প্রকৃত অর্থে এটা ব্যক্তির নিজের সমমানের অথবা নিম্নমানের কারও অসম্মানজনক দাসত্ব। যখন মানুষের ঘাড়ে সব খায়েশের পেছনে দৌড়ানোর এবং সব নিয়মনীতির বন্ধন থেকে ছিটকে পড়ার প্রবণতা চেপে বসে, তখন বুঝে নিতে হবে যে তাকে খায়েশ দাস বানিয়ে ফেলেছে। সে প্রবৃত্তির কাছে বন্দি হয়ে গেছে। তার জীবন পরিচালিত হচ্ছে এই প্রবৃত্তি ও খায়েশ ঘিরে। তো এটা কোন ধরনের স্বাধীনতা, যেখানে মান ও মূল্যের বিবেচনায় আরও নিম্নতর বস্তুর দাসে পরিণত হয় মানুষ! যদি মানুষের মূল্য বিবেচিত হয় তার খায়েশ ও চাহিদা পূরণের মাত্রা দিয়ে, তবে তো জীবজন্তুর মূল্য আরও বেশি এবং মর্যাদা আরও উঁচু হওয়ার কথা!
জীবজন্তু নিজ খায়েশ ও চাহিদার পেছনে কোনো রকমের লক্ষ্য ও বিধি-নিষেধ ছাড়াই দৌড়াতে থাকে। আর মানুষ নিজের ইচ্ছামতো খায়েশের পেছনে যতই দৌড়ঝাঁপ করুক না কেন, তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু বাধা-বিপত্তি তার সামনে আসবেই। তবে কি কেউ দাবি করে যে, এই জীবজন্তু, যার খায়েশ পূরণে কোনো প্রতিবন্ধক নেই মানুষ থেকে বেশি স্বাধীন ও অধিক সৌভাগ্যবান!
প্রকৃত স্বাধীনতা হলো নিজের প্রবৃত্তির ওপর কন্ট্রোল থাকা। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো আপনাকে কোনো খায়েশ ও চাহিদা দাসে পরিণত করতে না পারা। এই অর্থে ধর্মপ্রাণ মোমিনরাই পূর্ণ স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতা এ জাতীয় কোনো নিয়ম-কানুনে বিধিবদ্ধ নয়। দ্বীন ও ধর্ম তাদের সব ধরনের প্রবৃত্তি, খায়েশ ও লোভ থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করে দিয়েছে। তাদের হৃদয়কে জগৎসংসারের স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। তাদের চাওয়া-পাওয়াকে একমাত্র তাঁর ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। আল্লাহই সত্য ও বাস্তব। তিনিই হলেন সব কল্যাণ, ভালোবাসা ও রহমতের কেন্দ্রবিন্দু। অতএব সত্য, কল্যাণ ও করুণা যাকে অধীনে নিয়ে এসেছে, সে তো বাকি সব রকমের মন্দ গুণ থেকে স্বাধীন প্রমাণিত হয়ে গেল।
বস্তুত লোকদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশি স্বাধীন, যে যত বেশি আল্লাহর পরাধীন। তাদের কোনো গায়িকা দাসে পরিণত করতে পারে না, কোনো লোভ ও প্রবৃত্তি তাদের শাসন করতে পারে না, কোনো সম্পদ তাদের হীন করতে পারে না, কোনো লালচ তাদের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করতে পারে না, কোনো বাসনা ও খায়েশ তাদের অপদস্থ করতে পারে না এবং কোনো ঢর ও ভয় তাদের পরাধীন করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালার ইবাদত ও উপাসনা তাদের তিনি ব্যতীত অন্য সবকিছুর ভয় থেকে নির্ভয় ও স্বাধীন করে দিয়েছে। ‘মনে রেখো যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের না কোনো ভয়-ভীতি আছে, না তারা চিন্তান্বিত হবে। যারা ঈমান এনেছে এবং ভয় রয়েছে তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে এবং পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হলো মহাসফলতা।’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪)।
সুতরাং আল্লাহ তায়ালার একনিষ্ঠ ইবাদত ও আনুগত্যেই মানুষের আসল শান্তি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতা চর্চার উত্তম সময় হলো রমজানের বরকতময় মাস।