অাকাশ জাতীয় ডেস্ক:
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে ৬৬ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বা ২৩ শতাংশ বেশি। সুদের হার কমানো হবে- অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বার বার এমন বক্তব্যের পর অর্থবছরের শেষ দিকে এসে সঞ্চয়পত্র কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। সুদের হার কমলে কম মুনাফা পাওয়া যাবে, তাই বেশি লাভের আশায় আগেভাগেই তারা কিনে রাখছেন সঞ্চয়পত্র।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহা রোববার বলেন, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (জুলাই-জুন) মোট ৬৬ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এরমধ্যে নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ৫২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সুদের হার কমানোর খবরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে বলে মনে করেন বাবলু সাহা। বর্তমানে ব্যাংক আমানতে সুদের হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ হার ১১ থেকে ১২ শতাংশের মতো। বেশি সুদ পাওয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে খুব বেশি আশার খবর না থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সঞ্চয়পত্রই সাধারণ নাগরিকদের কাছে বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
>> ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট ১৭ হাজার ২৩২ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয় ১৭ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৭ টাকা।
>> ২০১১-১২ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১৮ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। সুদ-আসল শোধ করা হয় ১৮ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। নিট বিক্রি ছিল ৪৭৯ কোটি টাকা।
> ২০১২-১৩ অর্থবছরে মোট বিক্রি হয় ২৩ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। শোধ করা হয় ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৭২ কোটি টাকা।
> ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিক্রি হয় ২৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। সুদ-আসল বাবদ শোধ করা হয় ১২ হাজার ৬০২ টাকা। নিট বিক্রি ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা।
> ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকায়। গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয় ১৩ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। নিট বিক্রি দাড়ায় ২৮ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।
> ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট বিক্রি আরও বেড়ে ৫৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। শোধ করা হয় ২০ হাজার ২৩ কোটি টাকা। নিট বিক্রি ছিল ৩৩ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, “ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমায় এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই।
“অনেকে মেয়াদ পূর্তির পর সেই টাকা আবার বিনিয়োগ করেছেন। মুনাফার অর্থ জমিয়ে তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে নতুন বিনিয়োগ করেছেন। ডিপিএস ভাঙিয়েও অনেকে বেশি লাভের জন্য সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। যার ফলে মোট বিক্রির পাশপাশি নিট বিক্রিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।”
সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে বলেই সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে কবে থেকে কোন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কতটা কমানো হবে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু সাহা বলেন, “আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন নির্দেশনা আসেনি।”
বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে এর আগে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হলেও তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পুরো সময়ে (১২ মাসে, জুলাই-জুন) সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই সরকারকে এই ঋণ বহন করতে হচ্ছে; গুণতে হচ্ছে সুদ। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে হুঁশিয়ার করে আসছিলেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, “বিক্রি যেভাবে বাড়ছে সুদের হার কমানো ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো বিকল্প রাস্তা নেই। তবে আমার বিবেচনায় মহিলাদের জন্য পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমানোই সমীচীন হবে।”