বাংলার জন্য প্রাণ দিয়েছে আসামের বাঙালিরাও

0
232

অাকাশ আর্ন্তজাতিক ডেস্ক:

পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ে বাঙালির রক্তদান এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে গোটা বিশ্বই। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালিরা কেবল এখানেই প্রাণ দেয়নি। ভারতের আসামেও জীবনের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মান রেখেছে বাঙালিরা।

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির দাবি ১৯৪৮ সাল শুরু হলেও সেটি চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। আর আসামের বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচরে ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল নয় বছর পর, ১৯৬১ সালে।

ওই বছরের ১৯ মে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ১১ জন।

পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের মতোই আসামের বাঙালিরাও দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি আদায় করেই ঘরে ফিরেছিল। রক্তের বিনিময়ে বরাক উপত্যকার বাসিন্দারা অসমিয়ার পাশাপাশি বাংলাকেও সরকারি ভাষার স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। সুকুমার বিশ্বাসের ‘আসামের ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি প্রসঙ্গ’ বইয়ে সেদিনের সেই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।

বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের কাছাড় জেলার শিলচর রেল স্টেশনে জড় হয়েছিল হাজারো মানুষ। শুরু করেছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলন। দাবি ছিল, রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই আন্দোলনকে ভালো চোখে নেয়নি আসামের তৎকালীন সরকার। আর আন্দোলনকে দমনের জন্য মোতায়েন করা হয় আধাসামরিক বাহিনী।

মানুষের মুখে মুখে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে নানা স্লোগান। আন্দোলন শেষ হওয়ার কথা বিকাল চারটার মধ্যে। কিন্তু বেলা দুইটা ৩৫ মিনিটে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো শিলচর স্টেশনে। আধাসামরিক বাহিনী অতর্কিতে গুলি শুরু করে আন্দোলনকারীদের ওপর। যারা শহীদ হন তাদের সবারই বয়স ছিল ২৫ বছরের নিচে।

২০ মে ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশ হলে দেশজুড়ে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। দাবি ওঠে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। ৪০ হাজার মানুষের শোক মিছিল হয় শিলচরে। তার পরই ১১ শহীদের শেষকৃত্য হয় শিলচর শ্মশানে।

আজও সেই শ্মশানে এই ১১ শহীদের ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি স্মৃতিস্তম্ভের সামনে নামফলক রয়েছে শহীদদের। শুধু তাই নয়, শিলচর স্টেশনের সামনে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল এই ১১ তরুণ-তরুণীকে, সেখানেও তৈরি করা হয়েছে ১১টি স্মৃতিস্তম্ভ।

সেই ভাষা আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। আসামের দ্বিতীয় রাজ্যভাষা হয়েছে বাংলা। আর বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা হয়েছে বাংলা।

কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই মহান ভাষা পেল আসামবাসী, তাদেরকে ভাষা শহীদের মর্যাদা দিতে আসামের বাঙালিদেরকে পরেও নামতে হয়েছে আন্দোলনে।

বরাকবাসী ২০০৫ সালে নিহতদেরকে ভাষা শহীদের মর্যাদা এবং যে স্টেশনের সামনের তাঁরা শহীদ হয়েছেন সেটাকে ‘ভাষা শহীদ স্টেশন’ নামকরণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। শিলচরের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এই দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন চালিয়ে আসছিল।

১১ বছর পর ২০১৬ সালে আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলনে নিহতদের দেয় হয় ‘ভাষা শহীদ’ এর মর্যাদা।

প্রতি বছর ১৯ মে তাঁদের স্মরণে এখনো গোটা বরাক উপত্যকায় ভাষা শহীদ দিবস পালিত হয়ে আসছে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্য আসাম। আসামকে ভাগ করা হয়েছে দুটি উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বরাক উপত্যকা। বরাক উপত্যকায় রয়েছে তিনটি জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি। কাছাড় জেলার জেলা সদর শিলচর। এখানের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই বাঙালি বা বাংলায় কথা বলেন।

তবে বাংলা ভাষাভাষি পশ্চিমবঙ্গে এখনও বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবি জানাতে হচ্ছে। সর্বত্র ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন চলছে। সেখানে বিভিন্ন সংগঠন ভারত সরকারের কাছে বরাবরের মতই তাদের দাবিগুলো তুলে ধরছে।

তারা দাবি জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে, অফিসে আদালতের কাজকর্ম বাংলা ভাষায় করতে হবে, বিভিন্ন সরকারি আধা সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের সাইনবোর্ডে অন্যান্য ভাষার পাশে বাংলাকে আবশ্যিক করতে হবে, স্কুল কলেজে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও বাংলাভাষা পড়ানো আবশ্যিক করতে হবে, বাংলা ভাষাকে মর্যাদার সঙ্গে এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি ভারতের সব মাতৃভাষাকে সমানাধিকার দিতে হবে।

আসামের ভাষা শহীদ যারা

বাংলা ভাষার দাপ্তরিক মর্যাদার সংগ্রামে শিলচর রেলস্টেশনে শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা হলেন: কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, সচীন্দ্র চন্দ্র পাল, ধীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকমল পুরকায়স্থ ও কমলা ভট্টাচার্য।

এর মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য এবং শচীন পালের বয়স ১৮ পার হয়নি। শহীদ হওয়ার আগের দিন এ দুই জন স্কুলে দিয়েছিলেন জীবনের শেষ পরীক্ষা।