আকাশ জাতীয় ডেস্ক:
গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশে অনেক মানুষ বেকার হয়েছেন। আবার অনেকের চাকরি আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় সঞ্চয় তো দূরের কথা উল্টো জমানো অর্থ ভাঙছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সুদহার না কমিয়ে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এসব কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রধানত দুই কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে। আইনগত কড়াকড়ি এবং মহামারী করোনার সংকট। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সীমা নির্ধারণ এবং আয়কর হার বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত জুড়ে দেয়ায় সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এখন আগের মতো সহজে সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। এছাড়া করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথম দিকে সরকারের কড়াকড়ি; পরে করোনায় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন সঞ্চয়কারীরা। অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউবা আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় বাসা নিচ্ছেন। এভাবে যেখানে বাসা ছেড়ে দিতে হচ্ছে সেখানে সঞ্চয়ের তো কোনো সুযোগ নেই। এসব কারণে অস্বাভাবিক হারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান বলেন, মানুষের হাতে টাকা নেই। সঞ্চয় করবে কীভাবে। করোনায় মধ্যবিত্ত প্রায় শেষ। নিম্নবিত্ত তো করোনার প্রথম ধাক্কায় শেষ হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হলে শুধু টু-লেট আর টু-লেট। অর্থাৎ বাসা ভাড়া দেয়ার বিজ্ঞপ্তি। এর অর্থ মানুষ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ছিল। তবে লাগাম টানতে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বেশ কিছু শর্ত ও বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমতে থাকে। এরপর মার্চ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর স্থবির হতে শুরু করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে উৎপাদন ও বিনিয়োগের চাকা ছিল প্রায় বন্ধ। এতে অনেকেরই আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মে পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে যায়। তবে জুনে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে কিছুটা গতি এসেছে। জুনে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বিক্রি কমতে থাকায় পরবর্তী সময়ে তা কমিয়ে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ধরা হয়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে ৭১ দশমিক ১০ শতাংশ। এটি গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নিট ১১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এরপর প্রতি অর্থবছরেই সঞ্চয়পত্রে বড় ধরনের বিনিয়োগ আসে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৮ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেকর্ড ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছরে বাজেটের প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎস কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সব লেনদেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। দুর্নীতি কিংবা অপ্রদর্শিত আয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধ করতে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেস সংরক্ষণের লক্ষ্যে অভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিক্রি কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়া সঞ্চয়পত্রে বড় বিনিয়োগে কঠোর হয়েছে সরকার। চাইলেই ভবিষ্যতে তহবিল বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ নেই। এখন প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে কর কমিশনারের প্রত্যয়ন লাগে। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক ফার্মের নামে সঞ্চয়পত্র কিনতে লাগছে উপকর কমিশনারের প্রত্যয়ন। এসব কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।