ডায়মন্ডস ফ্রম সিয়েরা লিওন

0
344

অাকাশ আর্ন্তজাতিক ডেস্ক:

ব্রাসেলসের মিডি বলে পরিচিত রেলওয়ে স্টেশনটি আন্তর্জাতিক মানের। এখান থেকে ইউ রেলে চড়ে মানুষজন হামেশা যাচ্ছে ইংল্যান্ড কিংবা ফরাসি দেশে। চাইলে এ স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম অবধি যাওয়া যায় অনায়াসে। আমি সেদিন সিয়েরা লিওনের ইবোলা উপদ্রুত ফ্রিটাউন থেকে ব্রাসেলসে এসে ল্যান্ড করেছি। রাত কাটিয়েছি জানাশোনা একজনের অ্যাপার্টমেন্ট। আপাতত বসে বসে স্টেশনের কাচ ও ইস্পাতে তৈরি দালানের স্থাপত্যকলার বিশাল বৈভব দেখি। আমার ইরাদা হচ্ছে- এখান থেকে রেলগাড়ি পাকড়ে প্যারিস যাওয়া। স্টেশনের ইমারতটির খুঁটিনাটি অবজার্ভ করতে করতে কাচের ট্রান্সপারেন্ট দেয়াল ভেদ করে বাইরের পার্কিংলটের দিকে তাকাই। ইউরোপের ‘প্রিন্সিপাল রেলওয়ে-হাভ’ হিসেবে পরিচিত এ স্থাপনার সামনে লোকজন কিছু নেই দেখে তাজ্জব লাগে। প্ল্যাটফর্মের কায়দায় গড়া বিরাট আকৃতির হলঘরে হাঁটাচলা করতেই চোখ পড়ে বিশাল ডিসপ্লে বোর্ডে, প্যারিসের রেলগাড়িটি স্টেশন ছেড়ে গেছে মাত্র মিনিট বারো আগে। তবে হাতে যখন ইউ-রেলের কাগুজে টিকিট এসে গেছে- প্যারিস পেঁৗছানো নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো জরুরত নেই। ঘণ্টা দেড়েক পর পরই দ্রুতগামী ট্রেন ছুটছে ফরাসি রাজধানীর দিকে। এ যানবাহনের গতি ঘণ্টায় পাক্কা তিনশ’ কিলোমিটার। প্যারিস নগরীর ‘গারে ড্যু নর্ড ইস্টিশানে’ পেঁৗছতে লাগবে কাঁটায় কাঁটায় মাত্র এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট। আমার তেমন কোনো তাড়া নেই, তাই আলসেভাবে ওয়াশরুমের দিকে হেঁটে যেতে যেতে লবিতে চাকাওয়ালা স্যুটকেস ও হরেক কিসিমের ব্যাগ নিয়ে বসে থাকা প্যাসেনজার্সদের নিরিখ করে দেখি। মনে হয়, ভিন্ন ভিন্ন রকমের গাত্রবর্ণের নানা মানুষজন রীতিমতো আত্মসম্মোহিত হয়ে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে আছে ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে।

ওয়াশরুমের আয়নায় ইন্দোনেশিয়ান বাটিকের জবড়জং শার্ট পরা আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে সচেতন হই যে, আমাকে কেন জানি একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। পেপার টাওয়েল দিয়ে শেভ না করা গণ্ডদেশ থেকে জলের ঝাপটা মুছতে মুছতে অনুভব করি- বাটিকের রঙচঙে শার্ট ও জাকার্তা থেকে খানিক দূরের একটি আগ্নেয়গিরি মাউন্ট মিরাপির ছবি আঁকা ঝোলা কাঁধে ঝুলাতেই আমার মাঝে এসে গেছে হালকা চালে ঘুরে বেড়ানোর মুড। সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে দাতা সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করার বদৌলতে আমাকে হামেশা কাফলিংক জোড়া আস্তিন, কড়া স্টার্চ দিয়ে ইস্ত্রি করা শার্ট ও স্যুট পরে ঘুরপাক করতে হয়। কুঁচকানো বাটিকের হাতাকাটা হাওয়াই শার্ট পরায় পেশাদারি ধড়াচূড়ার পোশাকি গুটলি কেটে বেরিয়ে আসা প্রজাপতির মতো নির্ভার লাগে। খুব খোশ মেজাজে গোঁফে স্যান্ডাল উডের সঙ্গে আম্বার মেশানো সুরভির স্টিক ঘঁষে বেরিয়ে আসি লবির খানিক জনবহুল, তবে তুলনামূলকভাবে নিরিবিলি বাতাবরণে। হাঁটাচলা করতে করতে মনে হয়- স্যামস ক্যাফেতে খানিক জিরিয়ে নিয়ে পরের ট্রেনের জন্য ইন্তেজারির সময়টুকু পার করে দিলে মন্দ হয় না। উঁচু ছাদ থেকে অনেক নিচে নেমে আসা হলুদাভ শেডের রিডিং ল্যাম্পের তলায় ল্যাপটপ নিয়ে জাকিয়ে বসেছে জনাকয়েক প্যাসেনজার। তাদের কফির তপ্ত পেয়ালা থেকে উড়ছে যৎসামান্য ধোঁয়া। খুব জোশের সঙ্গে তারা ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে, ফেসবুকে পাঠাচ্ছে মেসেজ, উচ্চকিত হচ্ছে টুইটে। একজন যুবতী ক্যান্ডেলের স্ক্রিনে পেপারব্যাক পড়তে পড়তে পোষা সিয়ামিজ বেড়ালের মতো হাই তুলছে, চেয়ারের সিথানে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চুল থেকে দু’হাতে খুলে নিল হেয়ার-টাই, তার অন্তর্বাস উপচে যমজ শিশু-ভোঁদড়ের মতো বাইরে উঁকি দেয় অর্ধআচ্ছাদিত স্তন যুগল। দাবার ম্যাগনেটিক সেট খুলে আয়েশ করে বসেছেন লাল চুলো দুই আইরিশ। তারা এত সময় নিয়ে ঘুঁটির দিকে ধুন ধরে আছেন যে, মনে হয় কিশতি মাত হতে এখনও দেরি আছে ঢের। তিন প্রস্থ স্যুট পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ পত্রিকার ছবির দিকে এ্যায়সা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন যে, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তার স্বদেশ আফ্রিকার বুরুন্ডি কিংবা ক্যামেরুনে হয়ে গেছে তরতাজা সামরিক অভ্যুত্থান। আমি ক্যাফে-ওলের পেয়ালা হাতে তাদের সকলকে অতিক্রম করে বেশ দূরে বারস্টুল দিয়ে ঘেরা দীর্ঘ পায়ার রাউন্ড টেবিলে বসি।

কফিতে চুমুক দিতেই কাছেপিঠে কোথায় যেন খুব মৃদুস্বরে বাজে একটি চেনা গানের সুর। আমি চোখ বুঁজে কান পেতে শুনি, ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার/দে উন্ট লিভ ইউ ইন দ্য নাইট।’একটু বেজে খাট্ করে তা বন্ধ হয়ে যেতেই আতান্তরে পড়ি, রেলওয়ে স্টেশনের নিরিবিলিতে এ গান বাজাচ্ছে কে? চেনা এ লিরিকটি ‘ডায়মন্ডস ফ্রম সিয়েরা লিওন’ বলে পরিচিত। আমেরিকার হিপহপ আর্টিস্ট কেনিয়া ওয়েস্টের গাওয়া লোকপ্রিয় এ সঙ্গীতটি গ্র্যামি পুরস্কার পাওয়ার বদৌলতে বছর দশেক আগে মশহুর হয়েছিল তামাম দুনিয়ায়। আবার গুঞ্জরিত হয় সুরধ্বনি, ‘আই হ্যাভ নো ফিয়ার দ্যাট দে মাইট ডেজার্ট মি/থ্রো ইয়া ডায়মন্ডস ইন দ্য স্কাই, ইফ ইউ ফিল দ্য ভাইব।’ আমি কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বারস্টুল থেকে নেমে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক স্ক্যান করি। বেশ দূরে ঘোড়ার নালের মতো বাঁকা সোফায় আলগোছে রাখা গিটার, জোড়া আফ্রিকান ড্রামস ও কিছু রেকর্ডিং ইন্সট্রুমেন্ট। ওগুলোর সামনে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে কালো হিপ হ্যাগার জিন্স পরা মাঝারি হাইটের একটি মেয়ে। খুব মোলায়েম আওয়াজে আবার ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ বেজে ওঠতেই সে শরীরে সঙ্গীতের রিদমকে অ্যাবজর্ব করে হালকা চালে শেইক করে তার কটিদেশ। নিতম্বের দোলা থেকে পরিষ্কার চিনতে পারি- সিয়েরা লিওনের রাজধানী শহর ফ্রিটাউনের সোসাইটিতে ঘুরপাক করা আফ্রো-লেবানিজ মেয়ে কারমিনা ফাইরোজকে। লেবানিজ বাবা ও আফ্রিকান মায়ের শ্যামল বরণ মেয়েটি নৃত্যে পটীয়সী নয় একেবারে। সঙ্গীতেও নেই তার সহজাত কোনো দক্ষতা। তবে নিঃসঙ্গ কোনো ডিপ্লোম্যাট বা করপোরেটের কোনো পুরুষ কর্মকর্তার সঙ্গে সে এনগেজ হতে চাইলে লিপসিং করে লোকপ্রিয় কোনো গানের কলি ভাজা বা আই কনটাক্ট করতে করতে লাভলি ভঙ্গিতে কোমর দোলানোর তার স্বভাব আছে। এক সময় সে পার্টি, পরব, পিকনিক ও ককটেলে চাপলিশে জোগান দিত ড্যানসিং শু নামে একধরনের এক্সট্যাসি ট্যাবলেট। সেই থেকে কারমিনা ড্যানসিং শু নামেও পরিচিত হতে থাকে ফ্রিটাউনে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উন্নয়ন করনেওয়ালাদের বিচ পার্টি বা কোনো কূটনৈতিক কর্মকর্তার টেরাসে সূর্যাস্ত নিশানা করে জমে ওঠা সান-ডাউনারের পরবে কীভাবে যেন চেনাজানা কারও হিল্লা ধরে ঢুকে পড়ে কারমিনা ফাইরোজ। তার পাইথন সাপের চামড়ায় তৈরি ভারী পার্সে রাখা সোনার মিনা করা সিগারেট কেসটির সঙ্গে বিদেশ থেকে ফ্রিটাউনে আগত অনেক ডিপ্নোম্যাট বা এইড ওয়ার্কারদের পরিচয় আছে। তার সোনালি কেসে হামেশা মজুদ থাকে অ্যারোমেটিক টোব্যাকোতে জাম্বা বলে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন ক্যানোবিসের শুষ্কমঞ্জরি মেশানো হাতে রোল করা সিগ্রেট। সামাজিকভাবে কথাবার্তার ফাঁকে সে হিপহপের লোকপ্রিয় কোনো লিরিক লিপসিংয়ের কায়দায় গুনগুনিয়ে ভাজতে ভাজতে আগ্রহী মক্কেলের হাতে তুলে দেয় জাম্বার জোরালো জয়েন্ট। যিনি পণ্যটি ক্রয় করেন, তার দায়িত্ব বর্তায় আবডালে কারমিনার হাতে ইউরো কিংবা ডলারের একটি বিল ধরিয়ে দেওয়ায়।

স্ট্রাইরোফোমের ঠোঙায় করে স্ট্ন্যাকস ও কোক নিয়ে এসে তার সঙ্গে যোগ দেয় ক্লাইড পালমার নামে আমেরিকান এক মারকুটে পুরুষ। গাঢ় রঙের রোদচশমার সঙ্গে কয়েক দিনের না কামানো দাড়িতে ঢাকা পড়েছে ক্লাইডের চোখমুখের রুক্ষ নির্মমতা। চার পকেটওয়ালা মেক্সিকান শার্ট পরায় তাকে মারিয়াচি সিঙ্গারদের মতো দেখায়। মাস তিনেক আগে ফ্রিটাউনে ইবোলা ছড়াতে শুরু করলে শিকাগো থেকে ক্লাইড ফ্রিটাউনে কী একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আসে। তীব্রভাবে পেটা পেশিওয়ালা শরীরে তার মিলিটারি প্রশিক্ষণের ছাপ। সে দ্রুত ভিড়ে যায় ফ্রিটাউনের স্থানীয় হিপহপ গানের গ্রুপের সঙ্গে। শোনা যায় যে, মিউজিক সিনথেসাইজেশনে তার দক্ষতা প্রচুর। ‘ডায়মন্ডস ফ্রম সিয়েরা লিওন’ লিরিকটির স্ট্র্যাকচার ব্যবহার করে সে ইবোলা প্রতিরোধের বার্তা সংবলিত সঙ্গীত তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে স্থানীয় হিপহপ গাইয়েদের। তারপর পাশ্চাত্যের কূটনীতিকদের জন্য আয়োজিত এক সিকিউরিটি ব্রিফিংয়ে তার আসল পরিচয় জানতে পেরে আমি একটু তাজ্জব হই। ক্লাইড মূলত কাজ করছে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের কনসালট্যান্ট হিসেবে, অনেকটা প্রাইভেট ডিটেকটিভের মতো। ইবোলা প্রাদুর্ভাবের মওকায় ফ্রিটাউনে নাকি ত্রাণ-কর্মী হিসেবে ঢুকে পড়েছে কিউবা ও বেলেরুশিয়া থেকে আগত কিছু সাইবার ক্রিমিন্যাল। তারা হ্যাক করছে মার্কিন, আইরিশ ও ব্রিটিশ দূতাবাসের হরেক রকমের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ। তাদের সম্পর্কে ক্লাইডের কাছে আছে পাকা তথ্য। সে সবাইকে ওরিয়েন্টেশন দেয় কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে সাইবার অ্যাটাকের।

কারমিনা ফাইরোজ ও ক্লাইড পালমারকে একত্রে দেখে আমি স্বভাবত কৌতূহলী হই। তবে তাদের ব্রাসেলসের মিডি রেলওয়ে স্টেশনে বসে থাকতে দেখে অবাক হই না একেবারে। আন্দাজ করি_ আজকের ফ্লাইটে তারা ফ্রিটাউন থেকে ব্রাসেলসে এসেছে। এবার আমার মতো রেলগাড়ি পাকড়ে যাবে প্যারিসে। তা যাক, আমার ভেতরে কৌতূহল হিসাব মিলাতে শুরু করে। অবৈধ ড্রাগসের গোপন বিক্রিবাট্টার সঙ্গে কারমিনা সংযুক্ত। তবে কি সাইবার ক্রাইমের তৎপরতার ওপর সঙ্গোপনে নজরদারি করা ক্লাইড কারমিনার পণ্য অথবা শরীর ব্যবহার করছে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের কাজে? তাদের দু’জনের সঙ্গে আমি অল্পবিস্তর পরিচিত, কিন্তু এখনই আগ বাড়িয়ে তাদের কাছে গিয়ে হ্যালো বলার উৎসাহ পাই না।

দূর থেকে দেখি কারমিনা ফাইরোজ গ্রীবা বাঁকিয়ে কোনো লিরিকের লিপসিংয়ের ভঙিতে ঠোঁট নাড়ছে। তার এ আচরণের সঙ্গে আমার এক বিমর্ষ দিনের বিপন্ন অভিজ্ঞতা এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে যে, তাকে এ স্টেশনে দেখামাত্রই নিজের নিভৃত গহনে ফুটে ওঠে কয়েকটি অবাস্তব অপরাজিতা। মাত্র মাস খানেক আগের এক শুক্রবারে কোনো এক দূতাবাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে দাতা সংস্থায় আমি কাজ করি- তার সদর দপ্তর থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে আমাকে পেশাগতভাবে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়। বলা হয় যে, আমার একটি আচরণ সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্টের দপ্তরকে বিব্রত করেছে। আমাকে বিশেষ একটি নম্বরে টেলিফোন করে অ্যাপোলজি চাইতে বলা হয়। এ ঘটনার প্রেক্ষাপট হচ্ছে, ত্রাণ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া। অ্যাম্বুলেন্সগুলো হস্তান্তর করার সপ্তাহ খানেক পর খবর পাওয়া যায় যে, দুটি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরের কাঠামো বদলে তা দিয়ে সড়কে প্যাসেনজার্স টানা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য আমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানাই। পরে জানতে পারি- বাকি অ্যাম্বুলেন্সগুলোও নম্বর প্লেট বদলিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে মালপত্র স্থানান্তরের কাজে। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ড. আরনেস্ট করোমার দপ্তরে ইবোলা প্রতিরোধের কাজে সমন্বয় নিবিড় করার জন্য আমাদের ডাকা হলে আমি সে সুযোগে অ্যাম্বুলেন্স অপব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করি। এতে ফায়দা কিছু হয়নি, বরং উল্টো আমার সংস্থার সদর দপ্তর থেকে আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। এ সতর্কীকরণ ছিল আমার জন্য তীব্রভাবে অপমানজনক। আমি প্রতিবাদে পদত্যাগ করতে পারতাম। কিন্তু আমার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। প্রতিমাসে আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে ছোট্ট একটি বাড়ি কেনা বাবদ ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। মেয়ের পড়াশোনার জন্য খরচ জোগাতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। সে মুহূর্তে চাকরি ত্যাগ হতো আর্থিকভাবে মজদুর হয়ে যাওয়ার শামিল। তাই অপমান হজম করে অ্যাপোলজি চাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বেরিয়ে আসি কর্মস্থল থেকে।

বাসায় ফিরতে ইচ্ছা হয় না, তাই বিমর্ষতা কাটানোর জন্য চলে আসি র‌্যাডিসন ব্লু হোটেলে, এন্ড দেয়ার শি ওয়াজ, কারমিনা ফাইরোজ দাঁড়িয়ে আছে লবির লাগোয়া কফি শপের কিনারে। আমাকে দেখতে পেয়েই কী যেন এক গানের লিরিক লিপসিংয়ের ভান করে বলে, ‘বয়, ইউ লুুক সো ডাউন টুডে, ওয়ান্ট অ্যা ফেরারি রাইড?’ আমি জবাবে বলি, ‘লুকিং ফর অ্যা লিটিল ডানসিং শু।’ কারমিনা কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ফেরারি ইজ অ্যা হৌল লট বেটার- আসো আমার সাথে, তোমাকে জয়-রাইডে নিয়ে যাবো।’ ঘনিয়ে আসা বিকেলে আমরা আধো অন্ধকার বারে এসে বসি। নির্জন এ কামরায় ডিসকো বাতির আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে কৃত্রিম রঙধনু। ফেনা উপচানো বিয়ারের মগে চুমুক দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে ঠোঁট মুছে সে অন্তর্বাসের আবডাল থেকে বের করে আনে একটি দিয়াশলাই। তা থেকে আমি তুলে নিই ফেরারি ছদ্মনামে পরিচিত একটি এক্সট্যাসি ট্যাবলেট। সামান্য সময়ের ব্যবধানে অপরাহ্নের ভিডিও কনফারেন্সিং স্মৃতি আবছা হয়ে আসে। সুইমিং পুলের পাশে জমে ওঠা বাদ্যবাজনার রেশ খড়কুটো খোঁজা ছোট্ট পাখির মতো উড়ে এসে বসে আমার শরীরের সর্বত্র। একটু তৃষ্ণার অনুভূতি হয়, আর গানের পাখিগুলো ছোটাছুটি করে ঘাড়ে-মাথায় মৃদু কাকলি করে। ডিসকো বাতির বর্ণাঢ্য আলো ছাদে তৈরি করে রাশিচক্রের নকশা। তাদের ঘূর্ণায়মান রেখাচিত্রে ঘুরপাক করে একাধিক গ্রহ। কারমিনা বিদায় নেওয়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে গেলে আমি আকুল হয়ে তার দিকে তাকাই। সে কণ্ঠস্বরে মৃদু সুর তুলে বলে, ‘ইউ হ্যাভ মাই হার্ট/অ্যান্ড উই উইল নেভার বি ওয়ার্ল্ড অ্যাপার্ট। যখনই তুমি ফেরারিতে রাইড নিতে চাইবে, জাস্ট রিং মি আপ। ও-কে।’

ক্লাইড পালমার আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়িয়ে ওয়েভ করে। আমি বারস্টুল থেকে উঠে পড়ে তাদের হ্যালো বলতে এগিয়ে যাই। ‘হ্যালো ক্লাইড অ্যান্ড কারমিনা, হোয়াট আর ইউ গাইজ আপ টু?’ ক্লাইড কয়েক দিনের না কামানো দাড়িতে বাঁ হাতের তালু ঘঁষে বলে, ‘গোয়িং টু চেইজ ওয়াইল্ড গুজ ইন প্যারিস।’ আমি অধিক কোনো প্রশ্ন না করে কারমিনার কব্জি টিপে দিয়ে বলি, ‘হ্যাভ ফান গার্ল।’ বেশ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কুঁচকানো শার্টের বুকের কাছের দুটি বোতাম খামচে ধরে সে বলে, ‘ইউ লুক সো এথনিক টু-ডে, এসব রঙচঙে কাপড়চোপড়ে তোমাকে কী রকম যেন স্টোরি টেলারের মতো দেখাচ্ছে।’ আমি রেসপন্সে কিছু না বলে মনে মনে তার অবাক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবি। শুধু অবাক হওয়াই নয়, তার চোখে যেন ভাসছে একধরনের ডিস-কমফোর্টের ছায়া। তবে কি আমার সঙ্গে ব্রাসেলসের রেলওয়ে স্টেশনে দেখা হয়ে যাওয়ায় মেয়েটি অস্বস্তিতে পড়ল? কিন্তু তার তো ডিস-কমফোর্টেবল হওয়ার আদৌ কোনো কারণ নেই। আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইনফরমেশন বুথের দিকে যেতে যেতে ভাবি- হোয়াই কারমিনা ইজ ক্যারিং অল দিস গিটার অ্যান্ড ড্রামস, সে তো বাদ্যবাজনার বিশেষ কিছু জানে না। একটি ধারণা আমার করোটিতে বিদ্যুৎ চমকের মতো আলো ছড়ায়। তবে কি সে বাদ্যযন্ত্রগুলোর ভেতরে লুকিয়ে প্যারিসে স্মাগ্ল্ করছে এক্সট্যাসি বা অন্য কোনো ধরনের ড্রাগস । কিন্তু ক্লাইড তার সঙ্গে জুটেছে কেন? আফ্রো-লেবানিজ মেয়েটি কি ব্যবহৃত হচ্ছে তার তথাকথিত বুনোহাঁস শিকারের ফাঁদ হিসেবে?